Header Display ads

Bengali 2ed sem aecc question answer2021


Bengali-2edsem-question-answer



15×4=60


 1.সাম্য বাদ কবিতায় কাজী নজরুল ইসলাম যে সাম্যবাদ এর স্বপ্ন দেখেছেন তা বিশ্লেষণ করো?   15mark




কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর জীবনের শেষ অভিভাষণে বলেছেন আমার কাব্য আমার গান আমার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে জন্ম নিয়েছে। বিনা কারণে তিনি কিছুই সৃষ্টি করেন নাই। ‘এ নহে বিলাস বন্ধু...‘ গানে যেন তিনি এ কথাই বলেছেন।


একজন মহাপুরুষকে বুঝতে হলে তাঁর আগমনকালীন সমাজ ব্যবস্থা, পরিবেশ-পরিস্থিতিকে বুঝতে হয়। ১৮৯৯ সালের ২৪ মে চুরুলিয়ায় তাঁর জন্ম। ন’বছর বয়সে হন এতিম। পূর্বপুরুষ ছিলেন ভারতের বিচার বিভাগের উচ্চ পদস্থজন। কাজী উপাধি তারই সাক্ষ্য বহন করে।


একটি পরাধীন দেশে তাঁর জন্ম। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি ভারতের সব কিছু লুটপাট করে সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারে পাচার করছিল। দারিদ্রের কষাঘাত, ধনী-গরীবের আকাশ-পাতাল তারতম্য, যুদ্ধ-বিগ্রহ, হানাহানি, মারামারি, হিন্দু-মুসলমানে দিন রাত হানাহানি ইত্যাদি ছিল সেই সময়ের চিত্র।


১৯১৯ সালের দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে যখন নজরুল সাহিত্য জগতে প্রবেশ করেন, তখন পৃথিবীর ৭২ শতাংশ রাষ্ট্র ছিল উপনিবেশ, আর প্রায় সত্তর শতাংশ মানুষ ছিল পরাধীন। উপনিবেশ আর পরাধীনতার কষাঘাতে জর্জরিত মানুষ, পর্যুদস্ত মানবতা। অপরদিকে স্বাধীন রাষ্ট্রেও যে সকল মানুষ সুখী নয় তা তো বলাই বাহুল্য। মোটকথা, পৃথিবীর অধিকাংশ সম্পদ, ক্ষমতা মুষ্টিমেয় কতিপয় লোকের হাতেÑ যা তখনও ছিল এখনও আছে।


নজরুল এসেছিলেন সব ধরনের বৈষম্য দূর করার জন্য। কাজী নজরুল ইসলামের সাম্যবাদের এমন জোরালো প্রবক্তা পৃথিবীতে কোনো কবি-সাহিত্যিক পৃথিবীতে আমাদের জানামতে আর কেউ নেই।


বলাবাহুল্য নজরুলের সাম্যবাদ হৃদয়লব্ধ বস্তু। প্রজ্ঞার চেয়ে আবেগের প্রাধান্য তার মধ্যে বেশি। অনেক জায়গায় উচ্ছ্বাসের মুখে নজরুল কবিতার ভারসাম্য বজায় রাখতে পারেননি। এতদসত্ত্বেও তাঁর সাম্যবাদের মধ্যে যে সমাজ সচেতনতা, যে সংস্কার মুক্তিপ্রবণতা ও যে সাম্যপ্রীতি প্রকাশিত হয়েছে তা অনন্যসাধারণ। নজরুলের সাম্যবাদে ঈশ্বরের অস্বীকৃতি নেই। নজরুলের সাম্যবাদী উক্তি তাদের বিষয়েই, যারা মানুষের সমাজে কৃত্রিম ভেদাভেদ রচনা করে নিজেদের স্বার্থসাধনে রত। এই জগতে সকলেই অসাধু ভণ্ড নয়; কেননা ‘অর্ধেক এর ভগবান, আর অর্ধেক শয়তান।’ কাম, প্রলোভন ইত্যাদি মানবিক প্রবৃত্তি তো দেহধারী মাত্রের মধ্যেই উপস্থিত, কিন্তু এদের জয় করার সাধনস্পৃহাও সকল হৃদয়ে বর্তমান। নজরুলের সাম্যবাদে মানবিক দুর্বলতা স্বীকৃত এবং সেই সঙ্গে এই দুর্বলতাকে জয় করে নবসমাজ গঠনের ইঙ্গিতও পরিস্ফুট। ‘বারাঙ্গনা’ কবিতাটিতে তিনি পতিতা নারীর মাতৃত্বকেই মা বলে সম্বোধন করেছেন। পতিতাবৃত্তিকে তিনি সতীকর্ম বলেননি। কামনার পথেই সন্তান আসে। পতিতার ক্ষেত্রে এই কামনা অবৈধ সন্দেহ নেই। কিন্তু পতিতার ভাল হবার দ্বার রুদ্ধ করে দেয়াকে নজরুল সমর্থন করেননি। কেননা ‘পাপ করিয়াছি বলিয়া নাই কি পুণ্যের অধিকার? ‘ অসৎ চরিত্রের জন্যে যেমন নারী পতিতা হয়, তেমনি চারিত্রিক দোষের জন্যে নরকেও পতিত করা উচিত। নরনারীকে সমান সামাজিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করবার আকাক্সক্ষা থেকেই নজরুলের ‘বারাঙ্গন‘, ‘নারী’ প্রভৃতি কবিতার জন্ম। [নজরুল-চরিত মানস, ড. সুশীলকুমার গুপ্ত, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা (এপ্রিল ২০১২) পৃ. ১৬৬]


নজরুলের সাম্যবাদ সর্বব্যাপী, সর্বপ্লাবী। এর মধ্যে নেই কোনো অস্পষ্টতা, নেই কোনো ভণিতা-ভণ্ডামি। এটি অবশ্য নজরুল-মানসের সাধারণ বৈশিষ্ট্য যে, তিনি যা বিশ্বাস করেছেন তাই বলেছেন এবং যা বলেছেন তাই করেছেন। কোনো কিছু পাশ কাটিয়ে মহাকাব্য রচনার কবি তিনি নন। বরং সবকিছুকে হৃদয়ে ধারণ করে, জীবনের সবটুকু আকুতি দিয়ে মানবমুক্তির সনদ রচনার মহামানব তিনি। তিনি কবিÑ এটি তার আংশিক পরিচয়; প্রকৃত অর্থে গোটা পৃথিবীকে সৌন্দর্যময় মহাকাব্যে রূপান্তরের মহাকবি তিনি। সেই অর্থে তিনি মানবকুলের অন্তরঙ্গ বন্ধুদের অন্যতম।


মানুষকে নিয়েই পৃথিবী, মানুষের সুখ-শান্তির মধ্যেই সমগ্র পৃথিবীর সৌন্দর্য। মানুষ বলতে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষকেই বুঝতে হবে, কাউকে বাদ দিয়ে নয়। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই যদি সমান মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়, প্রতিটি মানুষের যদি মানবিক অধিকারের নিশ্চয়তা মেলে, তবেই পৃথিবী সৌন্দর্যের লীলাভূমিতে পরিণত হবে। আর এমন পৃথিবীই মানব জাতির সকলেই কামনা করেন, কেবল অত্যাচারীরা ব্যতীত। সুন্দর পৃথিবী-প্রত্যাশী মানবগোষ্ঠীর মধ্যে মুষ্ঠিমেয় যে ক’জন নকীবের ভূমিকা পালন করেছেন তাঁদেরই অন্যতম কাজী নজরুল ইসলাম।


চলমান ঘুণেধরা বিশ্বব্যবস্থার ভিত্ কাঁপানো নজরুলের শ্রেষ্ঠতম কবিতা ‘বিদ্রোহী’ যেন মানবমুক্তির আকুল-আকুতি যার শেষাংশে নজরুল-মানস পরিস্ফূটিত হয়েছে এভাবে


 ‘মহা- বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত


আমি সেই দিন হব শান্ত


যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,


অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না


বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত


আমি সেই দিন হব শান্ত! ’


(বিদ্রোহী: কাজী নজরুল ইসলাম)


নজরুল কেবল সাম্যের বাণী প্রচার করেননি, তিনি অসাম্যের কদর্য রূপটি প্রত্যক্ষ করেছেন, এর ভয়াবহতা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছেন এবং তাঁর সকল কর্ম ও সাধনা দিয়ে সব ধরনের অসাম্য দূর করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর সেই পথচলায় সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন আমাদের গোটা সাহিত্য, রেখে গেছেন মানবমুক্তির চিরকালীন উপাদান।


নজরুলের সাম্যবাদ চাপিয়ে দেয়া কোন বিষয় নয়, কারও দয়ার দানও নয়। বরং এটি প্রকৃতির আইনেরই অংশ যা অলঙ্ঘণীয়। এ পৃথিবীর মালিকানা কোন ব্যক্তি, জাতি, গোষ্ঠী বা দেশ বিশেষের নয়। মালিকানা একমাত্র আল্লাহর। আল্লাহর সৃষ্ট জীব হিসেবে সকল মানুষের সমঅধিকার রয়েছে সবকিছুর মধ্যে। আর এটিই সাম্যের মূলমন্ত্র। নজরুলের ভাষায়


রবি শশী তারা প্রভাত-সন্ধ্যা তোমার আদেশ কহে


‘এই দিবা রাতি আকাশ বাতাস নহে একা কারো নহে।


এই ধরণীর যাহা সম্বল


বাসে-ভরা ফুল, রসে ভরা ফল,


সু-স্নিগ্ধ মাটি, সুধাসম জল, পাখির কণ্ঠে গান,


সকলের এতে সমঅধিকার, এই তাঁর ফরমান!’


(ফরিয়াদ : কাজী নজরুল ইসলাম)


সাদা আর কালোর মধ্যে কোন বৈষম্য আনয়নের নৈতিক বা আইনগত অধিকার কারোর নেই। কেননা


শ্বেত পীত কালো করিয়া সৃজিলে মানবে, সে তব সাধ।


আমরা যে কালো, তুমি ভালো জান, নহে তাহা অপরাধ!


তুমি বল নাই, শুধু শ্বেতদ্বীপে


জোগাইবে আলো রবি-শশী-দীপে,


সাদা র’বে সবাকার টুঁটি টিপে, এ নহে তব বিধান।’


(ফরিয়াদ : কাজী নজরুল ইসলাম)


কিন্তু বিধির বিধানকে পদদলিত করে অসাম্যের রাজত্ব কায়েমের মাধ্যমে গোটা পৃথিবীকে অস্থির করে রেখেছে মানুষ নামধারী লোভী আর ঈর্ষাতুর কতিপয় পাপাত্মা। এরা কখনো রাজা, কখনো জমিদার, কখনো বা মহাজন সেজে অন্যের অধিকার অন্যায়ভাবে লুণ্ঠন করে।


নজরুলের কলমে তা ফুটে ওঠেছে এভাবে


তোমারে ঠেলিয়া তোমার আসনে বসিয়াছে আজ লোভী,


রসনা তাহার শ্যামল ধরায় করিছে সাহারা গোবী!


মাটির ঢিবিতে দু’দিন বসিয়া


রাজা সেজে করে পেষণ কষিয়া!


সে পেষণে তারি আসন ধসিয়া রচিছে গোরস্থান!


ভাই-এর মুখের গ্রাস কেড়ে খেয়ে বীরের আখ্যা পান!’


(ফরিয়াদ : কাজী নজরুল ইসলাম)


মানুষে মানুষে যারা বৈষম্যের জগদ্দল পাথর সৃষ্টি করে যাচ্ছে তাদের মূলোৎপাটন তো দূরের কথা, উল্টো তাদেরকে বীরের আখ্যা দেয়া হয়। প্রকৃতির বিধানের সাথে এ যেন এক নির্মম পরিহাস। কবি এ চিত্রটি এঁকেছেন এভাবে-


          জনগণে যারা জোঁকসম শোষে তারে মহাজন কয়,


          সন্তানসম পালে যারা জমি, তারা জমিদার নয়।


                   মাটিতে যাদের ঠেকে না চরণ,


                   মাটির মালিক তাঁহারাই হন


          যে যত ভণ্ড ধড়িবাজ আজ সেই তত বলবান্।


নিতি নব ছোরা গড়িয়া কসাই বলে জ্ঞান-বিজ্ঞান।


(ফরিয়াদ : কাজী নজরুল ইসলাম)


কিন্তু বৈষম্য সহ্য করা কোন মানুষেরই উচিত নয়। অত্যাচারিতদের বাহ্যত দুর্বল মনে হলেও কার্যত এরাই শক্তিশালী। কেননা এদের যে কেবল সংখ্যাধিক্যের শক্তি রয়েছে তা-ই নয়, এদের রয়েছে সততার অপরাজেয় শক্তি। অত্যাচারিতদের অপরিমেয় সেই শক্তির উদ্বোধন কামনা করেছেন নজরুল। এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে তিনি শত শতাব্দীর ঘুম ভেঙে সামনে যাবার স্বপ্ন-সাহস দেখিয়েছেন, অধিকার-হারা মানবগোষ্ঠীকে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে আত্মবিশ্বাস যুগিয়েছেন, তাদের শিখিয়েছেন দৃপ্ত উচ্চারণ-


তোমার দেওয়া এ বিপুল পৃথ্বী সকলে করিব ভোগ,


এই পৃথিবীর নাড়ী সাথে আছে সৃজন-দিনের যোগ।


তাজা ফুলে ফলে অঞ্জলি পুরে


বেড়ায় ধরণী প্রতি ঘরে ঘুরে,


কে আছে এমন ডাকু যে হরিবে আমার গোলার ধান?


আমার ক্ষুধার অন্নে পেয়েছি আমার প্রাণের ঘ্রাণ


এতদিনে ভগবান!


(ফরিয়াদ : কাজী নজরুল ইসলাম)


যারা উদার আকাশে কালিমা লেপন করছে, শান্তির বেলুন যারা গুলির আঘাতে জর্জরিত করছে, তাদের মূলোৎপাটন করতে না পারলে সত্যিকারের সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে না। তাই তো নজরুল-কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে-


যে-আকাশ হ’তে ঝরে তব দান আলো ও বৃষ্টি-ধারা


সে-আকাশ হ’তে বেলুন উড়ায়ে গোলাগুলি হানে কারা?


উদার আকাশ বাতাস কাহারা


করিয়া তুলিছে ভীতির সাহারা?


তোমার অসীম ঘিরিয়া পাহারা দিতেছে কা’র কামান?


হবে না সত্য দৈত্য-মুক্ত? হবে না প্রতিবিধান?


(ফরিয়াদ : কাজী নজরুল ইসলাম)


অসাম্যের প্রতিবিধান অবশ্যই হবে। কারণ ‘সাম্য’ সত্য। আর অসাম্য হ’ল দৈত্যরূপী মিথ্যা। দৈত্যের হাত থেকে সত্যকে মুক্ত করে সুন্দর পৃথিবী প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নজরুলকে আমরা পাই আপোসহীন হিসেবে, একজন নিরন্তর সাধক হিসেবে। তাঁর এ সাধনাকে দেখেছেন ‘সুন্দরের সাধনা’ হিসেবে।


মানবসৃষ্ট অসাম্যের সকল প্রাচীর ভেঙে নজরুল সাম্যের গান শুনিয়েছেন। মানব-সাগরে তিনি সকলকে সমান দৃষ্টিতে দেখেছেন এবং সাম্যের বার্তা সকলের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। তিনি লিখেছেন-


গাহি সাম্যের গান-


যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,


যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্লিম ক্রীশ্চান।


(সাম্যবাদী : কাজী নজরুল ইসলাম)


সাম্যের এমন সাবলিল আহ্বান কেবল বাংলা সাহিত্যেই নয়; বরং বিশ্ব সাহিত্যেও আর কোন কবির কাব্যে আমরা পাইনি। তিনি মানুষকে দেখেছেন সৃষ্টির শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন হিসেবে। মানুষের মধ্যে তিনি পারস্পরিক আত্মার সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন। ফলে তাঁর কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে সাম্যের সুললিত বাণী


গাহি সাম্যের গান


মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান্।


নাই দেশ-কাল পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,


সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।-


(মানুষ : কাজী নজরুল ইসলাম)


মানুষ এমন জীব যার মাঝে স্বয়ং স্রষ্টার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। আর এখানেই মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের মাজেজা। কিন্তু মানুষ যখন আপন স্রষ্টাকে আপনার মাঝে না খুঁজে অন্যত্র খুঁজে বেড়ায়, তখন একদিকে যেমন স্রষ্টার সাথে তার সহজাত সম্পর্কে ছেদ ঘটে, ঠিক তেমনি বিব্রত বোধ করেন স্বয়ং স্রষ্টা, অপদস্থ হয় গোটা মানব-সত্তা। তাই স্রষ্টাকে খুঁজতে হবে নিজের মধ্যে। তাতে স্রষ্টা এবং সৃষ্টি উভয়ের মাঝে সহজাত সম্পর্কটি অটুট থাকবে এবং মানুষ তার মর্যাদার জায়গাটি ধরে রাতে সক্ষম হবে।


কে তুমি খুঁজিছ জগদীশে ভাই আকাশ-পাতাল জুড়ে?


কে তুমি ফিরিছ বনে-জঙ্গলে, কে তুমি পাহাড়-চূড়ে?


হায় ঋষি-দরবেশ,


বুকের মানিকে বুকে ধরে তুমি খোঁজ তারে দেশ-দেশ!


সৃষ্টি রয়েছে তোমা পানে চেয়ে তুমি আছ চোখ বুঁজে,


স্রষ্টারে খোঁজো-আপনারে তুমি আপনি ফিরিছ খুঁজে!


(ঈশ্বর : কাজী নজরুল ইসলাম)


নজরুল প্রতিটি মানুষের মাঝেই স্রষ্টাকে প্রত্যক্ষ করেন। মানব-হৃদয় হ’ল স্রষ্টাকে পাবার তীর্থস্থান। ‘এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন মন্দির কাবা নাই’ কিংবা ‘কারো মনে তুমি দিও না আঘাত/ সে আঘাত লাগে কাবার ঘরে/ মানুষেরে তুমি যত কর ঘৃণা/ খোদা যান তত দূরে সরে সাম্যের এসব অমোঘ বাণী যাঁর কাব্য-কাননে জোরে-শোরে বিঘোষিত হয়েছে, তিনি আমাদের নজরুল, সাম্যের সার্থক রূপকার এক অনন্য মহাপুরুষ।


নজরুলের সাম্যের রূপরেখাটি এরকম


গাহি সাম্যের গান


বুকে বুকে হেথা তাজা সুখ ফোটে, মুখে মুখে তাজা প্রাণ!


বন্ধু এখানে রাজা-প্রজা নাই, নাই দরিদ্র-ধনী,


হেথা পায় না ক’ কেহ ক্ষুদ-ঘাঁটা, কেহ দুধ-সর-ননী।


অশ্ব-চরণে মোটর-চাকায় প্রণমে না হেথা কেহ,


ঘৃণা জাগে না ক’ সাদাদের মনে দেখে হেথা কালা-দেহ।


সাম্যবাদী স্থান


নাই কো এখানে কালা ও ধলার আলাদা গোরস্থান।


(সাম্য : কাজী নজরুল ইসলাম)


নজরুল পাপকে ঘৃণা করেছেন, কিন্তু পাপীকে নয়। চোর-ডাকাত, মিথ্যাবাদী তথা সকল পাপীর প্রতি তিনি বাড়িয়ে দিয়েছেন পরম মমতার হাত।


সাম্যের গান গাই


যত পাপী-তাপী সব মোর বোন, সব হয় মোর ভাই।


(পাপ : কাজী নজরুল ইসলাম)


আদম হইতে শুরু ক’রে এই নজরুল তক্ সবে


কম-বেশি করে পাপের ছুরিতে পুণ্যে করেছে জবেহ্।


বিশ্ব পাপস্থান


অর্ধেক এর ভগবান, আর অর্ধেক শয়তান


ধর্মান্ধরা শোনো


অন্যের পাপ গনিবার আগে নিজেদের পাপ গোনো!


(পাপ : কাজী নজরুল ইসলাম)


একজন পাপীকে এমন করে ভালবাসা যিনি দিতে পারেন, তিনিই তো আমাদের নজরুল। কিন্তু তাই বলে পাপকে তিনি প্রশ্রয় দেননি। উমর ফারুক (রা.) যখন মদ্যপানের অপরাধে আপন ছেলেকে দোররা মেরে হত্যা করেন, সেই বিষয়টিকে নজরুল দ্বিধাহীনভাবে চিত্রিত করেছেন এভাবে


এত যে কোমল প্রাণ,


করুণার বশে তবু গো ন্যায়ের করনি ক’ অপমান!


মদ্যপানের অপরাধে প্রিয় পুত্রেরে নিজ করে


মেরেছ দোর্রা, মরেছে পুত্র তোমার চোখের প’রে।


ক্ষমা চাহিয়াছে পুত্র, বলেছ পাষাণে বক্ষ বাঁধি


‘অপরাধ করে তোরি মত স্বরে কাঁদিয়াছে অপরাধী!’


(উমর ফারুক : কাজী নজরুল ইসলাম)


ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা উমর ফারুক (রা.) সাম্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। সাম্যের এ বিধান এমনি কঠোর এবং অলঙ্ঘণীয় যে, তা আত্মীয়-অনাত্মীয় মানে না, এমনকি পিতার হাতে পুত্রকে শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রেও সামান্যতম বাধার কারণ হয়ে দাঁড়ায় না। এমন সাম্যই তো নজরুলের আরাধ্য। তাই তো তিনি লিখেছেন


আবু শাহমার গোরে


কাঁদিতে যাইয়া ফিরিয়া আসি গো তোমারে সালাম করে।


(উমর ফারুক : কাজী নজরুল ইসলাম)


হযরত উমর ফারুককে নিয়ে নজরুল যে ‘নান্দীপাঠ’ রচনা করেছেন তা বিশ্ব সাহিত্যের সেরা সম্পদ। কিন্তু কেন এ নান্দীপাঠ? নজরুল নিজেই এর জবাব দিয়েছেন


... হে খলিফাতুল-মুসলেমিন! হে চীরধারী সম্রাট!


অপমান তব করিব না আজ করিয়া নান্দী পাঠ,


মানুষেরে তুমি বলেছো বন্ধু, বলিয়াছ ভাই, তাই


তোমারে এমন চোখের পানিতে স্মরি গো সর্বদাই!


(উমর ফারুক : কাজী নজরুল ইসলাম)


ইসলামের সাম্যের সুমহান আদর্শকে হযরত উমর (রা.) বাস্তব প্রয়োগের মাধ্যমে বিশ্বের ইতিহাসে যে উপমা স্থাপন করেছেন তা নজরুলকে আলোড়িত করেছে। তিনিও এমন সাম্যই প্রতিষ্ঠা করতে চান যেখানে মানুষকে মানুষ হিসেবে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত করা হয়, রাজা-প্রজা, ধনী-দরিদ্রে কোন তফাৎ থাকে না, দরিদ্রের কুটিরে স্বয়ং খলিফা আপন পিঠে করে খাবারের বোঝা পৌঁছে দেন, ভৃত্যকে উটের পিঠে চড়িয়ে খলিফা সে উটের রশি ধরে তপ্ত মরুতে এগিয়ে চলেন। ইসলামের সাম্যের বিধানের সার্থক প্রয়োগকারী উমর ফারুকের মধ্যে নজরুল দেখেছেন একজন আদর্শ রাষ্ট্রনায়কের পরিপূর্ণ প্রতিচ্ছবি।


মদীনা থেকে জেরুজালেম যেন সাম্যের এক মহাগাঁথা। সেই মহাগাঁথার মহাকবি হযরত উমর ফারুক (রা.)। আর নজরুলের কলমের তুলিতে তা হয়ে উঠেছে অনবদ্য। সাম্যের সেই মহানায়কের জেরুজালেম যাত্রাকে নজরুল যেভাবে চিত্রিত করেছেন তা নিম্নরূপ


হেরি পশ্চাতে চাহি


তুমি চলিয়াছ রৌদ্র্রদগ্ধ দূর মরুপথ বাহি


জেরুজালেমের কিল্লা যথায় আছে অবরোধ করি


বীর মুসলিম সেনাদল তব বহু দিন মাস ধরি।


দুর্গের দ্বার খুলিবে তাহারা, বলেছে শত্র“ শেষে


উমর যদি গো সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর দেয় এসে!


হায় রে! অর্ধেক ধরার মালিক আমিরুল মুমিনীন


শুনে সে খবর একাকী উষ্ট্রে চলেছে বিরামহীন।


সাহারা পারায়ে! ঝুলিতে দু’খানা শুকনো ‘খবুজ’ রুটি,


একটি মশকে একটুকু পানি খোর্মা দু-তিন মুঠি!


প্রহরীবিহীন সম্রাট চলে একা পথে উটে চড়ি


চলেছে মাত্র একটি ভৃত্য উষ্ট্রের রশি ধরি!


মরুর সূর্য ঊর্ধ্ব আকাশে আগুন বৃষ্টি করে,


সে আগুন-তাতে খই সম ফোটে বালুকা মরুর ’পরে।


কিছুদূর যেতে উট হতে নামি কহিলে, ‘ভৃত্যে ভাই,


পেরেশান বড় হয়েছ চলিয়া! এই বার আমি যাই


উষ্ট্রের রশি ধরিয়া অগ্রে, তুমি উঠে বসো উটে;


তপ্ত বালুতে চলি যে চরণে রক্ত উঠেছে ফুটে!’


 


... ভৃত্য দস্ত চুমি


কাঁদিয়া কহিল, ‘উমর! কেমনে এ আদেশ করো তুমি?


উষ্ট্রের পিঠে আরাম করিয়া গোলাম রহিবে বসি


আর হেঁটে যাবে খলিফা উমর ধরি সে উটের রশি?’


 


খলিফা হাসিয়া বলে,


‘তুমি জিতে গিয়ে বড় হতে চাও, ভাই রে, এমনি ছলে!


রোজ-কিয়ামতে আল্লা যেদিন কহিবে, উমর! ওরে,


করেনি খলিফা মুসলিম-জাঁহা তোর সুখ তরে তোরে!’


কি দিব জওয়াব, কি করিয়া মুখ দেখাব রসুলে ভাই?


আমি তোমাদের প্রতিনিধি শুধু! মোর অধিকার নাই


আরাম সুখের, -মানুষ হইয়া নিতে মানুষের সেবা!


ইসলাম বলে সকলে সমান, কে বড় ক্ষুদ্র কে-বা!’


ভৃত্য চড়িল উটের পৃষ্ঠে উমর ধরিল রশি,


মানুষে স্বর্গে তুলিয়া ধরিয়া ধুলায় নামিল শশী!


জানি না, সেদিন আকাশে পুষ্পবৃষ্টি হইল কি- না,


কি গান গাহিল মানুষে সেদিন বন্দি, বিশ্ববীণা!


জানি না, সেদিন ফেরেশতা তব করেছে কি না স্তব,-


অনাগত কাল গেয়েছিল শুধু, ‘জয় জয় হে মানব!’...


 


আসিলে প্যালেস্টাইন, পারায়ে দুস্তর মরুভূমি,


ভৃত্য তখন উটের উপরে, রশি ধরে চলো তুমি!


জর্ডন নদী হও যবে পার, শত্র“রা কহে হাঁকি


‘যার নামে কাঁপে অর্ধ পৃথিবী, এই সে উমর নাকি?’


খুলিল রুদ্ধদুর্গ-দুয়ার! শত্র“রা সম্ভ্রমে


কহিল- ‘খলিফা আসেনি, এসেছে মানুষ জেরুজালেমে!’


সন্ধিপত্র স্বাক্ষর করি শত্র“-গির্জা ঘরে


বলিলে, ‘বাহিরে যাইতে হইবে এবার নামাজ তরে!’


কহে পুরোহিত, ‘আমাদের এই আঙিনায় গির্জায়,


পড়িলে নামাজ হবে না কবুল আল্লার দরগায়?’


হাসিয়া বলিলে, ‘তার তরে নয়, আমি যদি হেথা আজ


নামাজ আদায় করি, তবে কাল অন্ধ লোকসমাজ


ভাবিবে- খলিফা করেছে ইশারা হেথায় নামাজ পড়ি


আজ হতে যেন এই গির্জারে মোর মসজিদ করি!


ইসলামের এ নহে কো ধর্ম, নহে খোদার বিধান,


কারো মন্দির গির্জারে করে ম’জিদ মুসলমান!’


কেঁদে কহে যত ঈসাই ইহুদি অশ্র“-সিক্ত আঁখি


‘এই যদি হয় ইসলাম- তবে কেহ রহিবে না বাকি,


সকলে আসিবে ফিরে


গণতন্ত্রের ন্যায় সাম্যের শুভ্র এ মন্দিরে!’


(উমর ফারুক : কাজী নজরুল ইসলাম)


নজরুল এমন সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছেন যেখানে রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে সকলে মিলে ন্যায় ও সাম্যের শুভ্র ঠিকানা প্রতিষ্ঠা করবে, যেখানে মানুষের মাঝে পারস্পরিক কোন ভেদাভেদ থাকবে না। এমনকি পাপী-তাপী, চোর-ডাকাতদেরও মানুষের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার সার্বিক প্রয়াস চালানো হবে পরম মমতায়।


চোর-ডাকাত কবিতায় কবি বিশ্বব্যাপী অসাম্যের কারণ অনুসন্ধানে প্রয়াসী হয়েছেন। প্রচলিত অর্থে আমরা যাদের চোর-ডাকাত হিসেবে চিহ্নিত করে শাস্তি দেই এবং সমাজচ্যুত করি, এদের চেয়েও ভয়ংকর হ’ল তারা যারা অন্যের সম্পদ লুট করে ‘পেতেছে বিশ্বে বণিক-বৈশ্য অর্থ-বেশ্যালয়’। আর এদের কারণেই


অন্ন, স্বাস্থ্য, প্রাণ, আশা, ভাষা হারায়ে সকল-কিছু,


দেউলিয়া হয়ে চলেছে মানব ধ্বংসের পিছু পিছু,


পালাবার পথ নাই,


দিকে দিকে আজ অর্থ-পিশাচ খুড়িয়াছে গড়খাই।


(চোর-ডাকাত : কাজী নজরুল ইসলাম)


নজরুল সাহিত্যে সাম্যের যে অমিয়ধারা প্রবাহিত হয়েছে তার উৎসমূল কোথায়? এ প্রশ্নের উত্তরে বোধ হয় এ কথা বলাই যথেষ্ট যে, তাঁর সৃষ্টি কোন বিলাসিতা ছিল না; বরং জীবনের অভিজ্ঞতা-সঞ্চিত। ড. সুশীলকুমার গুপ্ত লিখেছেনÑ ‘নজরুল কাব্যের এই বিদ্রোহাত্মক ভাবই পরবর্তী বাঙলা সাহিত্যে সাম্যবাদী ধারণা প্রচারে নজরুলের অবদান অবশ্য স্বীকার্য। ...বহু শিরোনামায় বিভক্ত ‘সাম্যবাদী’ কবিতায় নজরুল সাম্যবাদের প্রতি যে বিশ্বাস ও আন্তরিকতা দেখিয়েছেন, তার তুলনা বাঙলা সাহিত্যে প্রায় নেই বললেই চলে।’


সাম্য এবং উদারতা নজরুলের পারিবারিক ও ধর্মীয় উত্তরাধিকার। এর একটি সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন ড. সুশীলকুমার গুপ্ত ‘নজরুলের পূর্বপুরুষেরা পাটনার অন্তর্গত হাজীপুরের অধিবাসী ছিলেন। সম্রাট শাহ আলমের সময় তাঁরা বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার অন্তর্গত চুরুলিয়ায় এসে বসবাস আরম্ভ করেন। মোগল রাজত্বকালে এখানে যে একটি বিচারালয় ছিল তার কাজীর আয়মা সম্পত্তি প্রাপ্ত হন। কাজী নজরুল এই কাজীদেরই বংশধর। তাঁর বাড়ির পূর্বদিকে ছিল রাজা নরোত্তম সিংহের গড় আর দক্ষিণে পীরপুকুর। এই পুকুরের পূর্বপারে পীরপুকুরের প্রতিষ্ঠাতা সাধক হাজী পাহলোয়নের মাজার শরীফ এবং পশ্চিমপারে একটি ছোট সুন্দর মসজিদ। নজরুলের পিতা ও পিতামহ সমস্ত জীবন ধরে এই মাজার শরীফ ও মসজিদের সেবা করে পরিবারের ভরণপোষণ করে যান। মুসলমানধর্মের প্রতি অসাধারণ নিষ্ঠা থাকা সত্ত্বেও নজরুলের পিতা অন্য কোন ধর্মমতের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন ছিলেন না। ধর্মের ক্ষেত্রে পিতার এই উদারতা নজরুল উত্তরাধিকার হিসাবে পেয়েছিলেন। তাছাড়া ফারসী ও বাংলা কাব্যের প্রতি গভীর অনুরাগও তিনি লাভ করেছিলেন তাঁর পিতার কাছ থেকে।’


নজরুলের পিতার মৃত্যুর পর (১৯০৮) সংসারে নেমে আসে ভয়াবহ আর্থিক দুর্যোগ। নজরুল হাল ধরেন সংসারের। বাড়ির দক্ষিণে অবস্থিত পীরপুকুরের পূর্বপারে আল্লাহর অলি হাজী পাহলোয়ানের মাজার শরীফের খাদেম এবং পশ্চিমপারে অবস্থিত মসজিদে ইমাম, মুয়াজ্জিন এবং মক্তবের খাদেম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এসব কাজ থেকে পরিবারের জন্যে যতটা না অর্থের সংস্থান করেছেন তার চেয়ে ঢের বেশি তিনি নিজের জন্যে সঞ্চয় করেছেন ভবিষ্যত-পুঁজি। মসজিদে তিনি আজান দিয়েছেন, নামাজ পড়তে মুসল্লিগণ সমবেত হয়েছেন এবং তিনি দেখেছেন এক কাতারে, একই সমতলে দাঁড়িয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সকলে নামাজ পড়ছেন; ধনী, দরিদ্রে, রাজা-প্রজার কোন ভেদাভেদ নেই। ইসলামের সুমহান এ সাম্য নজরুলের কচি-মনকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে। এ কারণেই তিনি বড় হয়ে বলতে পেরেছেন


‘ইসলাম সে তো পরশ-মানিক তারে কে পেয়েছে খুঁজি?


পরশে তাহার সোনা হলো যারা তাদেরই মোরা বুঝি।’


(উমর ফারুক : কাজী নজরুল ইসলাম)


ইসলামের সুমহান সাম্য এবং সৌন্দর্য্যরে যে অপরূপ চিত্রটি নজরুল প্রত্যক্ষ করেছেন তাঁর শৈশবেই তা তাঁকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করে যা পরবর্তীকালে তাঁর সৃষ্টিশীল জীবনকে যথেষ্ট প্রভাবিত করে। তবে পতিত মুসলমানদের বিষয়ে তাঁর আক্ষেপের সীমা ছিল না। বিশ্বসভ্যতাকে সুরক্ষার জন্যে তিনি বারবার ফিরে গেছেন ইসলামের প্রাথমিক যুগে, স্বর্ণালী সময়টিতে। সাহায্য প্রার্থনা করেছেন আল্লাহ পাকের দরবারে, করুণ মিনতি জানিয়েছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব সর্বশেষ নবী ও রাসূল হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি


‘পাঠাও বেহেশত হতে হজরত পুনঃ সাম্যের বাণী,


(আর) দেখিতে পারি না মানুষে মানুষে এই হীন হানাহানি।’


বিশ্ব নিখিলের মুক্তির রূপটি নজরুল প্রত্যক্ষ করেছেন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মধ্যে


মানুষে মানুষের অধিকার দিল যে-জন


‘এক আল্লাহ ছাড়া প্রভু নাই কহিল যে-জন,


মানুষের লাগি চির দীন বেশ ধরিল যে-জন


বাদশাহ-ফকিরে এক শামিল করিল যে-জন


(আজি) মাতিল বিশ্ব-নিখিল মুক্তি কলরোলে॥


কিন্তু মহানবীর আদর্শ থেকে বিচ্যুতির ফলে আজ বিশ্ব জুড়ে হানাহানি আর মানুষে মানুষে বৈষম্যের সীমাহীন প্রাচীর গড়ে উঠেছে। ফলে অশান্তি বিরাজ করছে সর্বত্র। ব্যথিত নজরুল তাই হযরতকে স্মরণ করে লিখেন


তোমার বাণীরে করিনি গ্রহণ, ক্ষমা করো হজরত।


ভুলিয়া গিয়াছি তব আদর্শ তোমার দেখানো পথ।


বিলাস বিভবে দলিয়াছ পায়ে, ধূলি সম তুমি প্রভু,


তুমি চাহ নাই আমরা হইব বাদশা-নওয়াব কভু।


এই ধরণীর ধন-সম্ভার


সকলের তাহে সম-অধিকার,


তুমি বলেছিলে, ধরণীতে সবে সমান পুত্রবৎ।


তোমার ধর্ম্মে অবিশ্বাসীরে তুমি ঘৃণা নাহি করে


আপনি তাদের করিয়াছ সেবা ঠাঁই দিয়ে নিজ ঘরে।


ভিন-ধর্ম্মীয় পূজা মন্দির


ভাঙিতে আদেশ দাওনি, হে বীর,


আমরা আজিকে সহ্য করিতে পারি নাকো পর মত্॥


তুমি চাহ নাই ধর্ম্মের নামে গ্লানিকর হানাহানি,


তলওয়ার তুমি দাও নাই হাতে, দিয়াছ অমর বাণী।


মোরা ভুলে গিয়ে তব উদারতা


সার করিয়াছি ধর্ম্মান্ধতা,


বেহেশত হতে ঝরে নাকো আর তাই তব রহমত॥




ইসলাম ধর্মের অনুসারী বলে দাবিদার মুসলমানদের মধ্যে ইসলামের বাণীর পূর্ণ প্রতিফলন না দেখে নজরুল যেমন আহত হয়েছেন এবং এর প্রতিকারে সচেষ্ট হয়েছেন, ঠিক তেমনি হিন্দুধর্মের অনুসারীদের মধ্যে বিরাজমান জাতিভেদ প্রথা তাকে কতটা মর্মাহত করেছে তার প্রমাণ মেলে ‘জাতের নামে বজ্জাতি’সহ আরও অনেক লেখায়। কেবল একটি উদাহরণ দিচ্ছি


জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াৎ খেলছ জুয়া।


ছু’লেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয়তো মোয়া।


হুঁকোর জল আর ভাতের হাঁড়ি, ভাবলি এতেই জাতির জান,


তাই ত বেকুব, করলি তোরা এক জাতিকে একশ-খান!


এখন দেখিস ভারত-জোড়া,


প’চে আছিস বাসি মড়া,


মানুষ নাই আজ, আছে শুধু জাত-শেয়ালের হুক্কা হুয়া॥


জানিস না কি ধর্ম্ম সে যে বর্ম্ম সম সহন-শীল,


তাকে কি ভাই ভাঙতে পারে ছোঁওয়া-ছুয়ির ছোট্ট ঢিল।


যে জাত-ধর্ম্ম ঠুনকো এত,


আজ নয় কাল ভাঙবে সে ত,


যাক না সে জাত জাহান্নামে, রইবে মানুষ, নাই পরোয়া॥


দিন-কানা সব দেখতে পাসনে দণ্ডে দণ্ডে পলে পলে,


কেমন করে পিষছে তোদের পিশাচ জাতের জাঁতা-কলে


তোরা জাতের চাপে মারলি জাতি,


সূর্য্য ত্যজি নিলি বাতি,


তোদের জাত-ভগীরথ এনেছে জল জাত বিজাতের জুতো ধোওয়া।


মনু ঋষি অণু সমান বিপুল বিশ্বে যে বিধির,


বুঝলি না সেই বিধির বিধি, মনুর পায়েই নোয়াস শির।


ওরে মূর্খ ওরে জড়,


শাস্ত্র চেয়ে সত্য বড়,


তোরা চিনলি নে তা চিনির বলদ, সার হল তাই শাস্ত্র বওয়া॥


সকল জাতই সৃষ্টি যে তাঁর, এ বিশ্ব মায়ের বিশ্ব-ঘর,


মায়ের ছেলে সবাই সমান, তাঁর কাছে নাই আত্মপর।


তোরা সৃষ্টিকে তাঁর ঘৃণা করে,


স্রষ্টায় পূজিস জীবন ভরে,


ভস্মে ঘৃত ঢালা সে যে বাছুর মেরে গাভী দোওয়া॥


বলতে পারিস বিশ্ব-পিতা ভগবানের কোন সে জাত?


কোন ছেলের তাঁর লাগলে ছোঁওয়া অশুচি হন জগন্নাথ?


নারায়ণের জাত যদি নাই,


তোদের কেন জাতের বালাই?


তোরা ছেলের মুখে থু থু দিয়ে মার মুখে দিস ধূপের ধোয়া॥


ভগবানের ফৌজদারী-কোর্ট নাই সেখানে জাত-বিচার,


তোর পৈতে টিকি টুপি টোপর সব সেথা ভাই একাক্কার!


জাত সে শিকেয় তোলা র’বে, কর্ম্ম নিয়ে বিচার হবে,


তার পর বামুন চাড়াল এক গোয়ালে, নরক কিংবা স্বর্গে থোওয়া ॥


এই আচার বিচার বড় করে প্রাণ-দেবতায় ক্ষুদ্র ভাবা।


বাবা এই পাপেই আজ উঠতে বসতে সিঙ্গী-মামার খাচ্ছ থাবা!


তাই, নাই ক অন্ন, নাই ক বস্ত্র,


নাই সম্মান, নাই ক অস্ত্র,


এই জাত-জুয়াড়ীর ভাগ্যে আছে আরো অশেষ সুখ সওয়া॥


নজরুল তাঁর জীবনের উষালগ্নেই রুটির দোকানে কাজ করে শ্রমজীবীদের দুর্দশা প্রত্যক্ষ করেছেন, যৌবনে যুদ্ধের ময়দানে মানবতার বিপর্যয় অবলোকন করেছেন, জীবনের নানাবিধ ঘাত-প্রতিঘাতে ধনী-দরিদ্রের প্রকট বৈষম্য, হিন্দু মুসলিম দ্বন্দ্ব-সংঘাত, মানুষে মানুষে হানাহানি, লোভাতুরের নির্মম থাবা ইত্যাদি দেখেছেন, হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছেন এবং তাঁর জীবনের সর্বশক্তি দিয়ে এ সকল অনাচার-অবিচারের মূলোৎপাটনের চেষ্টা করেছেন, সৃষ্টি করে গেছেন অনবদ্য সব সাহিত্য; বাংলা সাহিত্যকে দিয়ে গেছেন অহংকারের একটি জায়গা যা নিয়ে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো যায়।



2. মহুয়ার দেশ  কবিতা কবি মহুয়ার দেশের যে চিত্র অঙ্কন করেছেন তার পরিচয় দাও?  15mark



কবি কল্পনা কাব্য রচনার অন্যতম বিষয়, কারণ কবির কল্পনা কোন কাব্যের আলংকারিক অর্থ দান করে, আর পাঠকের সেই কাব্য লোকে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। আলোচ্য মহুয়ার দেশ কবিতাটিতে কবি সমর সেন ঠিক একই রকমভাবে আমাদের  মহুয়ার দেশে নিয়ে গেছেন। 


    বস্তুতপক্ষে মহুয়ার দেশের চিত্র যে কবি কল্পনায় অন্য কোন বিচিত্র রূপ লাভ করেছে তা নয়, মহুয়ার দেশ তা যেন কবিতায় আপন মহিমায় আমাদের সামনে ফুটে উঠেছে। নগরকেন্দ্রিক যান্ত্রিক সভ্যতা থেকে কবি যেহেতু মুক্তি পেতে চেয়েছেন তাই তার মুক্তির অন্যতম স্থান হয়ে ধরা দিয়েছে তার কাব্য লোকের এই মহুয়ার দেশ টি। 


    সেই কারণে সাধারণভাবেই মহুয়ার দেশ কে তিনি কবিতাতে অসাধারণ ভাবে চিত্রিত করেছেন। মহুয়ার দেশ এর শুরুতে তিনি বর্ণনা করেছেন সমস্ত রাস্তার দুধারে দীর্ঘ প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে থাকা দেবদারু গাছের দীর্ঘ রহস্য কে।  যে রহস্যের জন্ম হয়েছে অরন্যের গভীরতা থেকে, যাকে তিনি নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা তে খুঁজে পাননি। 


    গভীর মহুয়ার বন, কালো কয়লা খনি, সেখানকার মানুষের অবসন্ন শরীর, শরীরে লেগে থাকা ধুলোর কলঙ্ক, আর তাদের ক্লান্ত ঘুমহীন চোখ যেন মহুয়া দেশের অনন্য চিত্র দান করেছে। এই মহুয়ার দেশের কাছে কবির একমাত্র আক্ষেপ তার ক্লান্তিকে নিবারণ করবে শুধু মহুয়ার ফুল, কবি কল্পনায় মহুয়ার দেশের এই চিত্রটি যেন অনাবিল কল্পলোকের বাস্তবতা। 


3.লম্ব কর্ণ শুধু হাস্য রস এর গল্প নয় নিটোল দম্পতির প্রেমের গল্প অভিমত টির যুক্তিকতা বিচার করো? 15 mark


অরূপকুমার পাল, ঝাড়গ্রাম


রাজশেখর বসুর 'লম্বকর্ণ' আছে বাস্তবেও!

রাজশেখরের গল্পে ম্যাজিস্ট্রেট রায় বংশলোচন ব্যানার্জির প্রাণ বাঁচিয়েছিল 'লম্বকর্ণ।' ঝাড়গ্রামে দুই কন্যার প্রাণ বাঁচল বাস্তবের লম্বকর্ণের জন্য। ম্যাজিস্ট্রেটের প্রাণ বাঁচানোয় তাঁর স্ত্রী মানিনীর আপন হয়ে উঠেছিল রাজশেখর বসুর কল্পনার লম্বকর্ণ। বাস্তবের লম্বকর্ণ সাত দিন বয়সে মা-কে হারানোর পর আদর পেয়েছিল দুই নাবালিকা উমা আর লক্ষ্মীর। ছাগ-মায়ের অভাব ভুলিয়ে দিয়েছিল উমা, লক্ষ্মী। দুই বোন ছাগ শিশুটির নাম দিয়েছিল 'শানু।'

রাজশেখরের গল্পে সেই ম্যাজিস্ট্রেটই একদিন তাড়িয়ে দিয়েছিলেন লম্বকর্ণকে। বাস্তবে অভাবের সংসারে দু' পয়সা আসবে বলে লম্বকর্ণকে বিক্রি করে দিয়েছিলেন গৃহকর্তা তারাপদ পাতর। এর পর তাঁর দুই মেয়ে উমা ও লক্ষ্মী এমন কাণ্ড বাঁধায় যে তারাপদের ছেলে গুণাগার দিয়ে ফিরিয়ে আনেন শানুকে। লম্বকর্ণের জন্য যে নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করেছিল উমা, লক্ষ্মী। তাতে প্রথমে কান দেয়নি পরিবার। কিন্তু দুই কন্যাই ব্লেড দিয়ে হাত চিরে রক্তারক্তি করার পর ফেরাতে হয় শানুকে।

যে কসাইয়ের কাছে ১০ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়েছিল শানুকে, তাঁকে খুঁজে বের করে সেই দামের সঙ্গে আরও ৫০০ টাকা যোগ করে লম্বকর্ণকে ফের উমা, লক্ষ্মীর হাতে ফেরাল পরিবারটি। উমা, লক্ষ্মীর দাদা নেপাল বলেন, 'আমি শানুকে ফিরিয়ে আনতে গেলে কসাই বলেন, ১০ হাজার টাকা দামটা তো ফেরাতেই হবে, তার সঙ্গে আরও ১০০০ টাকা না-দিলে তিনি ছাগল ছাড়বেন না। শেষে অনেক বুঝিয়ে ১০ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে রফা করে নিয়ে এসেছি।' সব শুনে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক সুজিতকুমার পাল বলেন, 'রাজশেখরের 'লম্বকর্ণ' শুধু আর গল্পে থাকল না৷ সমাজে চতুষ্পদ প্রাণী আর মানুষ এক হয়ে গিয়েছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে। আমরা যে শুধু খাওয়ার জন্য প্রাণীদের পুষি, তা নয়৷ ওদের মধ্যেও যে মনুষ্যত্ব আছে, তা দুই বোন প্রমাণ করল৷' ঝাড়গ্রাম শহরের শক্তিনগরে উমা, লক্ষ্মীদের প্রতিবেশী শঙ্কর ধারা বলেন, 'সত্যিই একটা ছাগল পরিবারটাকে জোড়া লাগিয়ে দিল।'

উচ্চ মাধ্যমিক পাশ উমা আর অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী লক্ষ্মী তাদের আদরের শানুর সঙ্গেই সারা দিন কাটায়। 'লম্বকর্ণ' মাঠে চরতে গেলে সঙ্গে ওরা থাকে। রাতে এক বিছানায় ঘুমোয় ওরা। শীতে একই লেপ বরাদ্দ ৩ জনের জন্য। গরমে ফ্যান। উমা জানিয়েছে, প্রকৃতির ডাক বুঝলে শানু পা দিয়ে তাদের ঠেলে ইঙ্গিত দেয়। তখন বাইরে নিয়ে যেতে হয় ওকে। কখনও বিছানা নষ্ট করেনি। দু' বেলা উমা-লক্ষ্মীর সঙ্গেই গরম ভাত, ডালের লাঞ্চ, ডিনার এবং চা, রুটি দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে শানু। আগামী সোমবার শানুর জন্মদিন। কেক কেটে সেলিব্রেশনের পরিকল্পনা ছিল দুই বোনের। শনিবার ঘুম থেকে উঠে দেখে শানু নেই। মা-কে জেরায় জেরবার করে বুঝতে পারে ছাগলটিকে বিক্রি করে দিয়েছেন তাদের বাবা তারাপদ। এর পরই হুলুস্থুল।

তারাপদ বলেন, 'এমন হবে, কী করে বুঝব বলুন। ছোট মেয়েটার পড়াশোনার খরচ আছে। সংসারেও অনেক খরচ। তাই বেচে দিয়েছিলাম। আর সেই চেষ্টা করব না। ওরা যে ব্লেড দিয়ে হাত কেটে আমাদের চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল।' রাজশেখরের লম্বকর্ণের সঙ্গে শানুর অনেক মিল। গল্পের লম্বকর্ণ ম্যাজিস্ট্রেটের চুরুট সাবাড় করে দিত। ঝাড়গ্রামের শানু গৃহকর্তার ফেলে রাখা বিড়ি চিবিয়ে খায়। পেলে ঢকঢক করে মদও গিলে ফেলে। তবে শানু তো আধুনিক লম্বকর্ণ। তাই পরিবারের সবার সঙ্গে বসে মন দিয়ে টিভির সিরিয়ালও দেখে












4.বিভূতি ভূষণ বন্দ্যো পাধ্যায় এর পুই মাচা গল্পের tragidy আলোচনা করো?

সংসার, যাপিত জীবন, সমাজের রীতিনীতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন সহায়হরির সাথে বাস্তববাদী, নীতিনৈতিকতায় বলিষ্ট, কঠোর অথচ মমতাময়ী একজন নারীর চরিত্র অঙ্কনের মধ্য দিয়ে বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় পুঁই মাচা গল্পে যে সমাজের কথা বলেছেন সে সমাজে বিষফোড়ার মতো স্থান করে নিয়েছে বাল্যবিবাহ আর যৌতুক প্রথা। গল্পে তিনি জীবনের জটিল মনস্তত্বের কোন ব্যাখ্যা দাড় করাননি বরং দিনহীন একটি পরিবারের স্বাভাবিক করুন কাহিনী সহজ সরল ভাষায় বর্ণনার মধ্য দিয়ে তৎকালীন সমাজের একটি চিত্র এঁকেছেন।


স্ত্রী এবং তিন মেয়েকে নিয়ে সহায়হরির অভাব অনটনের সংসার। বড় মেয়ের বয়স তেরতে পড়েছে। এ বয়সেও বিয়ে না হওয়ায় তার স্ত্রীর দুঃশ্চিন্তার শেষ নেই। মেয়ের বিয়ে না হওয়ায় তাকে যে একঘরে করার কথা হচ্ছে সে উদ্বেগের কথা সে তার স্বামীকে জানায় কিন্তু সহায়হরির সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। সংসারের প্রতি তার এই উদাসিনতার রাগ গিয়ে পড়ে মেয়েদের উপর।

এক বিকেলে বড় মেয়ে কিছু পুঁই শাক আর চিংড়ি মাছ চেয়ে চিনতে নিয়ে আসে। বড় মেয়ের ক্ষেন্তির পছন্দ কুচো চিংড়ি দিয়ে পুঁইশাক। কিন্তু মায়ের রাগে তোড়ে তা ফেলে দিয়ে আসতে হয়। পরে বাড়িতে যখন কেই থাকে না তখন তার মা ফেলে দেয়া পুঁইশাক কুড়িয়ে নিয়ে এসে রাঁধে। দুপুরে খেতে বসে পুইশাক পাতে দেখে ক্ষেন্তির চোখ ছলছল করে ওঠে। পুঁইশাক ক্ষেন্তির এতো পছন্দের ছিলো যে ঘরের কোনায় সে লাগিয়ে রাখে পুঁইশাক। মাচা ভর্তি সে পুঁইশাক লকলক করে বাড়তে থাকে।

বৈশাখ মাসের প্রথমে সহায়হরির এক দূর-সম্পৰ্কীয় আত্মীয় ঘটকালিতে ক্ষেত্তির বিবাহ হয়ে যায়। দ্বিতীয়পক্ষে বিবাহ করলেও পাত্রটির বয়স চল্লিশের খুব বেশি কোনোমতেই হবে না । দীনহীন সহায়হরি যৌতুকের টাকা ধীরে ধীরে শোধ করছিলো। কিন্তু টাকা না পেয়ে ক্ষেন্তির উপর অত্যাচার বাড়তে থাকে। এরমাঝে মেয়ের বসন্ত হলে গা থেকে সোনা গয়না খুলে তাকে ফেলে রেখে যায় পাশেই অপরিচিত এক আত্নীয়ের বাড়ীতে। সে বাড়ীতেই মৃত্যু হয় ক্ষেন্তির।


এই হলো পুঁইমাচা গল্পের কাহিনী। আহামরি কোন গল্প নয়, তবে বিভুতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় ভাষায়, পরিবেশ ও পরিস্থিতির চিত্রণে এমন মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন যে সাধারণ একটি কাহিনী অসাধারণ হয়ে উঠেছে।

"স্ত্রী অন্নপূর্ণ খড়ের রান্নাঘরের দাওয়ায় বসিয়া শীতকালের সকালবেলা নারিকেল তেলের বোতলে ঝাটার কাটি পুরিয়া দুই আঙুলের সাহায্যে কাটার কাটিলগ্ন জমানো তৈলটুকু সংগ্ৰহ করিয়া চুলে মাখাইতেছিলেন। স্বামীকে দেখিয়া তাড়াতাড়ি গায়ের কাপড় একটু টানিয়া দিলেন মাত্র. . ."

এটি গ্রাম বাংলার শীতের সকালের চিরপরিচিত চিত্র, তা মনে হয় কাউকে এর চেয়ে বেশি করে বর্ণনা দিয়ে বোঝানোর প্রয়োজন পড়ে না। শুধু দুলাইনের একটি বর্ণনায় কেমন জীবন্ত হয়ে উঠেছে এ সকালটি।

বিভুতিভুষণ বন্দোপাধ্যায় যে সময়ে গল্পটি লিখেছিলেন সে সময়ে বাল্যবিবাহ এবং যৌতুকপ্রথা ছিলো সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সঙ্গতকারণেই এটি গল্পের মুল বিষয়, তবে মুল বিষয়টি বলতে গিয়ে বিভুতিভুষণ বন্দোপাধ্যায় বেশি সময় বা শব্দ ব্যবহার করেন নি। ক্ষেন্তির উপর শ্বশুর বাড়ীর নির্যাতন , যৌতুক ও তার মৃত্যুর বিষয়টি প্রতিবেশি বিষ্ণু সরকারের সাথে আলাপচারিতায় স্বল্পকথায় বর্ণনা করেছেন -

"আমার স্ত্রী অত্যন্ত কান্নাকাটি করাতে পৌষমাসে দেখতে গেলাম। মেয়েটার যে-অবস্থা করেছে। শাশুড়িটা শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে লাগল, না-জেনেশুনে ছোটলোকের সঙ্গে কুটুম্বিতে করলেই এরকম হয়, যেমনি মেয়ে তেমনি বাপ, পোষ মাসের দিন মেয়ে দেখতে এলেন শুধু-হাতে!"

"মেয়ে তো কিছুতে পাঠাতে চায় না। আড়াইশো আন্দাজ টাকা বাকি ছিল, বললে ও টাকা আগে দাও তবে মেয়ে নিয়ে যাও।

—তারপর বললাম, টাকাটা ভায়া ক্ৰমে-ক্রমে দিচ্ছি। "

আর প্রিয় মেয়েটির মৃত্য ঘটনা এমনভাবে তুলে ধরেছেন অমনযোগী পাঠকের তা দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারে-

–তারপর ফাগুন মাসেই তার বসন্তু হল। এমন চামার-বসন্ত গায়ে বেরুতেই টালায় আমার এক দূর-সম্পর্কের বোন আছে, একবার কালীঘাটে পুজো দিতে এসে তার খোঁজ পেয়েছিল—তারই ওখানে ফেরে রেখে গেল। আমায় না একটা সংবাদ, না কিছু। তারা আমায় সংবাদ দেয়। তা আমি গিয়ে...

গল্পের সবচেয়ে উজ্জ্বল চরিত্র ক্ষেন্তির মা অন্নপূর্ণ। নীতি নৈতিকতা, কঠোরতা, কোমলতা, মমতাময়ী মা এসবের অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে এ চরিত্রে। মুলত এ চরিত্রটির কারনেই গল্পটি অসাধারণ হয়ে উঠেছে।

"স্ত্রীর অতিরিক্ত রকমের শান্ত সুরে সহায়হরির মনে ভীতির সঞ্চার হইল। ইহা -যে ঝড়ের অব্যবহতি পূর্বের আকাশের স্থিরভাব মাত্র, তাহা বুঝিয়া তিনি মরিয়া হইয়া ঝড়ের প্রতীক্ষায় রহিলেন। "


মুখুয্যে বাড়ী যাওয়ার পথে জঙ্গলের ভিতর থেকে পনের ষোল সের ওজনের একটি মেটে আলু চুরি করে তুলে ঘাড়ে করে নিয়ে এসে সহায়হরি যখন উঠোনে ফেললো তখন তার স্ত্রীর প্রশ্নের কোন জবাই সে দিতে পারলো না। তার স্ত্রী তখন বললেন—"চুরি তো করবেই, তিন কাল গিয়েছে এক কাল আছে, মিথ্যা কথাগুলো আর এখন ৰোলো না ...আমি সব জানি।" - "তোমার তো ইহকালও নেই, পরকালও নেই, চুরি করতে ডাকাতি করতে, যা ইচ্ছে করো, কিন্তু মেয়েটাকে আবার এর মধ্যে নিয়ে গিয়ে ওর মাথায় খাওয়া কিসের জন্যে? "

মেয়ের বিয়ে নিয়ে সহায়হরির স্ত্রী যখন তার স্বামীর সাথে বাকবিতন্ডা করছিলেন তখন ক্ষেন্তি ও তার দুইবোন মাথায় করে একগোছা পাকা পুঁইশাক মাথায় করে ঘরে ঢুকলো। সহায়হরি আনন্দিত হলেও অন্নপূর্ণা দাওয়া হইতেই অত্যন্ত ঝাঁজের সহিত চিৎকার করিয়া উঠিলেন-"নিয়ে যা, আহা কী অমর্তই তোমাকে তারা দিয়েছে...পাকা পুঁইডাটা কাঠ হয়ে গিয়েছে, দু-দিন পরে ফেলে দিত...নিয়ে যা... আর উনি তাদের আগাছা উঠিয়ে নিয়ে এসেছেন-ভালোই হয়েছে, তাদের আর নিজেদের কষ্ট করে কাটতে হল না." ক্ষেন্তির চোখ ছলছল করে উঠলো। ছোট মেয়েটি তা নিয়ে ফেলে দিয়ে আসলো। দুপুরে রাঁধতে গিয়ে ক্ষেন্তির পুঁইশাক পছন্দের কথা তার মনে হলো। বাড়িতে কেহ ছিল না, তিনি নিজে গিয়া উঠানের ও খিড়কি-দোরের আশেপাশে যে ডাটা পড়িয়াছিল, সেগুলি কুড়াইয়া লইয়া আসিলেন— বাকিগুলো কুড়ানো যায় না, ডোবার ধারের ছাই-গাদায় ফেলিয়া দিয়াছে। কুঁচো চিংড়ি দিয়া এইরূপে চুপিচুপিই পুইশাকের তরকারি রাঁধিলেন। দুপুরবেলা ক্ষেত্তি পাতে পুঁইশাকের চচ্চড়ি দেখিয়া বিষ্ময় ও আনন্দপূর্ণ ডাগর চোখে মায়ের দিকে ভয়ে-ভয়ে চাহিল

গল্পের সবচেয়ে করুন আর হৃদয়স্পর্শী বর্ণনা আছে শেষের দুটি প্যারায়। গল্পটির ভিন্নরকম আমেজ এবং পুঁই মাচা গল্পটির নামকরণের বিষয়টি পাঠক এখানে এসেই বুঝতে পারে ।

তারপর সে-রাত্রে অনেকক্ষণ কাটিয়া গেল। পিঠে গড়া প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছে...রাতও তখন খুব বেশি।...জোছনার আলোয় বাড়ির ফিচনের বনে অনেকক্ষণ ধরিয়া একটা কাঠঠোকরা পাখি ঠক-র-র-ল্ শব্দ করিতেছিল, তাহার স্বরটাও যেন ক্রমে তন্দ্ৰালু হইয়া পড়িতেছে...দুই বোনের খাইবার জন্য কলার পাতা চিরিতে চিরিতে পুটি অন্যমনস্কভাবে হঠাৎ বলিয়া উঠিল-দিদি বড় ভালোবাসত...


তিনজনেই খানিকক্ষণ নির্বাক হইয়া বসিয়া রহিল, তাহার পর তাহদের তিনজনেরই দৃষ্টি কেমন করিয়া আপনাআপনি উঠানের এককোণে আবদ্ধ হইয়া পড়িল.যেখানে বাড়ির সেই লোভী মেয়েটির লোভের স্মৃতি পাতায়পাতায় শিরায়-শিরায় জড়াইয়া তাহার কত সাধের নিজের-হাত-পোতা পুঁইগাছটি মাচা জুড়িয়া বাড়িয়া উঠিয়াছে। বর্ষার জল ও কার্তিক মাসের শিশির লইয়া, কচি-কচি সবুজ ডগাগুলি মাচাতে সব ধরে নাই, মাছা হইতে বাহির হইয়া দুলিতেছে...সুপুষ্ট, নধর, প্রবর্ধমান জীবনের লাবণ্যে ভরপুর!..


পুঁই মাচার এই লাবণ্যে ভরপুর কচি সবুজ ডগাগুলোর মাঝে তিনজনই যেন ক্ষেন্তির অবয়ব খুঁজে পায়। এমন ডাগর ডাগর মেয়েটির অকাল প্রয়ানের কথা স্মরণ করে তিনজনই নিবাক বসে থাকে।


গল্পটির সবচেয়ে বড় সার্থকতা এর মেদহীন বর্ণনা। দিনহীন একটি পরিবারের স্বাভাবিক জীবনযাপন আর কথপোকথনের মাধ্যমে সে সময়ের চিত্র, সামাজিক সমস্যার প্রেক্ষিতে করুন একটি কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে। বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের সমাজ চিত্রনের এই দক্ষতা আর কারো মাঝে খুঁজে পাওয়া যায় না।


ধন্যবাদ।

যদি আপনাদের কিছু মাত্র সাহায্য করতে পেরেছি তবে অবস্যই কমেন্ট করে জানাবেন।



1.Also read:  কিভাবে অপরিচিত মেয়েদের গার্ল ফ্রেন্ড  বানাবেন 


2. Also read: How to push rank on bgmi in 2021.


3:also read:How to remove🔕 recoil in (B.G.M.I)|ব্যাটেলগ্রাউন্ড মোবাইল ইন্ডিয়ার (B. G. M. I) কিভাবে recoil কমাবেন করবেন


4 also read:এন্ড্রোইড এবং আই ফোনের ব্যাটারী লাইফ ইমপ্রুভ


Free math mock for ❤mts 2020(exam date 5oct 2021)









Post a Comment

0 Comments

close